মোবাইল বা কম্পিউটার কেনার সময় আমরা প্রসেসর শব্দটি অনেকবার শুনে থাকি। হয়ত অনেকে প্রশ্ন করেন প্রসেসর কি ও এর কাজ কি। প্রসেসর বা সিপিইউ (সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট) হলো মূলত একটি কম্পিউটার বা মোবাইলের ভিতর থাকা চিপ/হার্ডওয়্যার, যা সফটওয়্যার এর দেওয়া কমান্ড অনুসরণ করে বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করে।
বর্তমানের প্রসেসরসমুহ সেকেন্ডে মিলিয়ন মিলিয়ন কমান্ড প্রসেস করতে পারে। সিপিইউ বা প্রসেসরকে কম্পিউটার/মোবাইলের প্রধান চিপ অথবা মস্তিষ্ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কোনো একটি নতুন ডিভাইসের মুল আকর্ষণ কিন্তু এর প্রসেসর হয়ে থাকে। তবে প্রসেসর সম্পর্কে আমাদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষেরই তেমন কোনো বিস্তারিত ধারণা নেই। চলুন জেনে নেওয়া যাক এই বহুল আলোচিত প্রসেসর কি ও প্রসেসর এর কাজ কি সে সম্পর্কে।
আগেই জানিয়ে রাখছি, এই পোস্টে সাধারণ প্রসেসরের মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এটি কোনো একাডেমিক আলোচনা নয়, বরং কৌতূহলী পাঠকদের জন্য সহজসরল একটি ধারণামাত্র। এটা আপনার ক্লাস বা একাডেমিক কাজের জন্য নয়। একাডেমিক প্রয়োজনে অনুগ্রহ করে আপনার পাঠ্যপুস্তক বা শিক্ষকের সহায়তা নিন।
প্রসেসর কি?
কম্পিউটার, স্মার্টফোন এবং এধরণের যন্ত্রসমূহে বিভিন্ন কমান্ড গ্রহণ ও সে অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন করিয়ে নেয় প্রসেসর। প্রসেসর ছাড়া কোনো কম্পিউটার বা স্মার্টফোন কোনো প্রোগ্রাম রান করতে পারেনা। এটি কমান্ডের ইনপুট নেয় ও সে অনুযায়ী আউটপুট দেয়। প্রসেসর নিজেই একটি হার্ডওয়্যার যে অন্যান্য হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার থেকে কমান্ড নেয়। এরপর প্রসেসর এই কমান্ড “প্রসেস বা প্রক্রিয়াজাত” করে ও সংশ্লিষ্ট হার্ডওয়্যার বা সফটওয়্যার দ্বারা উক্ত কমান্ডের কাজ সম্পন্ন করে।
যেমন মনে করুন আপনি একটি পিসিতে পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করতে চান। আপনি কিবোর্ডের মাধ্যমে পাসওয়ার্ড টাইপ করে এন্টার দিলেন। তখন প্রসেসর আপনার পিসির সিস্টেমে সংরক্ষিত পাসওয়ার্ডের সাথে আপনার প্রদত্ত পাসওয়ার্ড যাচাই করবে। যদি পাসওয়ার্ড মিলে যায় তাহলে প্রসেসর আপনাকে লগিন করিয়ে পরবর্তি স্ক্রিনে নিয়ে যাবে। যদি না মিলে তাহলে সে সফটওয়্যারের কাছ থেকে এরর মেসেজ নিয়ে স্ক্রিনে দেখাবে। সেই সাথে স্পিকারে ওয়ার্নিং সাউন্ড প্লে করতে পারে।
প্রসেসরকে সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট বা সিপিইউ বলা হয়ে থাকে। তবে একটি কম্পিউটারে একাধিক প্রসেসর থাকতে পারে, যেমনঃ গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট (জিপিইউ)। এর মধ্যে সিপিইউ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রসেসর ইউনিটসমুহ কমান্ড গ্রহণ করে থাকে র্যান্ডম অ্যাকসেস মেমোরি অর্থাৎ র্যাম থেকে। যখনই কোনো নির্দেশনা প্রদান করা হয় তখন সিপিইউ তা ডিকোড করে তা পারফর্ম করে আউটপুট প্রদান করে।
বর্তমানে কম্পিউটারের ক্ষেত্রে ইন্টেল ও এএমডি এর প্রসেসর সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। ইন্টেল এর কোর আর এএমডি এর রাইজেন প্রসেসরসমুহ ডেস্কটপ প্রসেসরের দুনিয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয়।
অন্যদিকে অ্যাপল, এনভিডিয়া, কোয়ালকম, মিডিয়াটেক, ইত্যাদি চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বেশিরভাগ মোবাইল ডিভাইসের জন্য প্রসেসর তৈরী করে থাকে।
প্রসেসর কোথায় থাকে?
প্রসেসর এর বিভিন্ন অংশ ও এসব অংশের কাজ জানার আগে কম্পিউটারের/ফোনের কোন হার্ডওয়্যারটিকে প্রসেসর বলা হচ্ছে সেটিও জানা জরুরি। কম্পিউটার এর প্রসেসর সাধারণত মাদারবোর্ডে থাকে।
সিপিইউ সকেট বা সিপিইউ স্লটে প্রসেসর লাগানো থাকে। মাদারবোর্ড এর সাথে প্রসেসর যাতে যথেষ্ট ভালোভাবে আটকে থাকে, তা নিশ্চিত করতে সিপিইউ স্লটের সাথে একটি লিভার লাগানো থাকে।
মোবাইলের ক্ষেত্রেও মাদারবোর্ডে প্রসেসর যুক্ত থাকে। এটি পিসির চেয়ে আরও শক্তভাবে আটকানো থাকে। সাধারণত মোবাইলের প্রসেসর কেউ পরিবর্তন করেনা। তবে কম্পিউটারের প্রসেসর ব্যবহারকারীদের পরিবর্তন করতে দেখা যায়।
প্রসেসর এর বিভিন্ন অংশ
প্রসেসর কিভাবে কাজ করে – তা বুঝতে হলে আগে প্রসেসরের গঠন সম্পর্কে ধারণা রাখা জরুরি। একটি কম্পিউটার প্রসেসর এর চারটি প্রধান কম্পোনেন্ট থাকেঃ এএলইউ, এফপিইউ, রেজিস্টার্স, ও ক্যাশ মেমোরি।
এরিথমেটিক লজিক ইউনিট বা এএলইউ কম্পিউটারের সকল গাণিতিক ও লজিক অপারেশন পরিচালনা করে। এএলইউ পূর্ণসংখ্যা নিয়ে কাজ করে। অন্যদিকে ফ্লোটিং পয়েন্ট ইউনিট বা এফপিইউ ফ্লোটিং-পয়েন্ট সংখ্যাসমুহ নিয়ে কাজ করে, যার সংখ্যাসমুহ এক ডেসিমেলের অন্তর্ভুক্ত।
কম্পিউটারের বিভিন্ন অংশ থেকে পাওয়া বিভিন্ন নির্দেশনা সংরক্ষণ করে রেজিস্টার। এএলইউ এর কি করতে হবে তা রেজিস্টার নির্দেশ করে ও তার তথ্য জমা রাখে।
প্রসেসরে এল২ ও এল৩ মেমোরি থাকে। এই মেমোরি থাকার দরুণ প্রসেসরের পক্ষে ক্যাশ ডাটা লোকালি সেভ করা সম্ভব হয়। যার ফলে র্যাম থেকে তথ্য আদান-প্রদান ছাড়াই প্রসেসর নিজেই প্রদত্ত কমান্ড দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে। এর মাধ্যমে সিপিইউ অধিক কার্যকরী হয় ও দ্রুত কাজ করে।
প্রসেসর কিভাবে কাজ করে?
প্রসেসর কি ও এর বিভিন্ন অংশ সম্পর্কে তো আমরা ধারণা পেয়ে গেলাম। এবার চলুন জানি কিভাবে প্রসেসর কাজ করে।
প্রসেসরসমুহের কোর এর দিকে নজর দিলে দেখা যাবে যে তারা আদতে একই ধরনের প্রসেস ব্যবহার করে। এসব প্রসেসকে বলা হচ্ছে ফেচ-এক্সিকিউট সাইকেল। এই সাইকেলের তিনটি ধাপ হলোঃ ফেচ, ডিকোড ও এক্সিকিউট।
ফেচ
ফেচিং হলো ফেচ-এক্সিকিউট সাইকেলের প্রথম ধাপ। এই ধাপে একটি প্রসেসর কোনো নির্দেশনা ফেচ বা গ্রহণ করে। প্রসেসরকে দেওয়া এই নির্দেশনা র্যাম থেকে প্রসেসরে পাঠানো হয়।
ডিকোড
রেজিস্টার থেকে নির্দেশনা পরবর্তী ধাপে পাঠানো হয় ও প্রসেসর ডিকোডার ব্যবহার করে প্রদত্ত নির্দেশনা প্রসেস করে। এরপর প্রদত্ত নির্দেশনাসমুহকে কিছু সিগনালে রুপান্তর করে প্রসেসর, যাতে প্রসেসরের অন্যান্য অংশ এই তথ্য ব্যবহার করে কার্য সম্পাদন করতে পারে।
এক্সিকিউট
এই ধাপের শেষে ডিকোড করা নির্দেশনাসমুহ প্রসেসর এক্সিকিউট বা সম্পাদন করে। নির্দেশনাসমুহ প্রসেসরের অন্য অংশে সম্পাদনের জন্য পাঠানো হয়ে থাকে।
প্রদত্ত নির্দেশনা সম্পাদনের পর তা রেজিস্টার সেভ করে রাখে। এর ফলে প্রসেসরের স্পিড বাড়ে, কেননা পরেরবার একই ধরনের কোনো নির্দেশনা সম্পাদনের আগে আগে প্রসেস করা তথ্য ব্যবহার করতে পারে প্রসেসর।
প্রসেসর এর স্পেসিফিকেশন
প্রসেসর এর ধরন থেকে শুরু করে এর কাজ করার প্রক্রিয়া পর্যন্ত সবই আমরা জানলাম। এবার চলুন জেনে নেওয়া যাক প্রসেসর বা সিপিইউ সম্পর্কিত কিছু প্রয়োজনীয় স্পেসিফিকেশন সম্পর্কে।
৩২-বিট ও ৬৪-বিট প্রসেসর
প্রসেসর সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকেঃ ৩২-বিট ও ৬৪-বিট। প্রসেসরের বিভিন্ন অংশে একই সময়ে কত বিট তথ্য আদান-প্রদান সম্ভব তা এর উপর নির্ভর করে।
৩২-বিট প্রসেসরসমুহ তাদের পাওয়ার প্রসেসিং এর জন্য কার্যকর। তবে বেশি বিট মানেই যেহেতু প্রসেসর অধিক শক্তিশালী (একই মানদণ্ডে), তাই সম্প্রতি ৬৪-বিট প্রসেসরের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
ক্লক স্পিড
একটি প্রসেসর সেকেন্ডে কতটি নির্দেশনা প্রসেস করতে পারে, তার পরিমাপ হচ্ছে ক্লক স্পিড। ক্লক স্পিড মাপার জন্য গিগাহার্টজ একক ব্যবহার করা হয়। প্রসেসরের স্পেসিফিকেশনের মূলকেন্দ্র হিসেবে ক্লক স্পিডকে বিবেচনা করা হয়। ক্লক স্পিড যত বেশি হবে, প্রসেসর তত ভালো হবে।
এল২/এল৩ ক্যাশ
সাধারণভাবে ব্যবহৃত তথ্য এল২ ও এল৩ মেমোরিতে জমা করে প্রসেসর। প্রতিটি নির্দেশনা সম্পাদনের জন্য র্যাম এর সাহায্য নেওয়া বদলে সাধারণ তথ্যগুলোর ক্ষেত্রে এই মেমোরি ব্যবহার করে প্রসেসর।
প্রসেসরের অংশ হওয়ায় এল২ ও এল৩ ক্যাশ র্যাম থেকে অতি দ্রুত কাজ করে। ক্যাশ যত বেশি হবে, পিসি ততো দ্রুত চলবে।
প্রসেসরের কোর কিভাবে কাজ করে?
আগের দিনে কম্পিউটার প্রসেসরে শুধুমাত্র একটি কোর ছিলো। যার মানে হলো নির্দিষ্ট সময়ে শুধুমাত্র একটি প্রদত্ত কাজ সম্পাদনে সক্ষম উক্ত প্রসেসর বা সিপিইউ।
হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের প্রচুর পরিশ্রমের ফলস্বরুপ আমরা পেয়েছি মাল্টি-কোর প্রসেসর যা বর্তমানে স্ট্যান্ডার্ড হয়ে দাড়িয়েছে। মাল্টি-কোর প্রসেসরের একাধিক কোর থাকায় একই সময়ে একাধিক কাজ সম্পাদনে সক্ষম এই প্রসেসরসমুহ।
আজকের দিনের বেশিরভাগের কম্পিউটারের দুইটি ও চারটি কোর রয়েছে। এসব সেটাপকে যথাক্রমে ডুয়াল কোর ও কোয়াড কোর বলা হয়। কাজের উপর ভিত্তি করে কিছু প্রসেসরের ৬৪টি পর্যন্ত কোর বিদ্যমান।
মোবাইল প্রসেসর কি?
ইতোমধ্যেই জেনেছেন, শুধুমাত্র কম্পিউটার নয়, বরং আপনার হাতের স্মার্টফোনটিও প্রসেসর দ্বারা চালিত। মূলত মোবাইল ডিভাইসসমুহ ও বহনযোগ্য কম্পিউটারের জন্য তৈরীকৃত প্রসেসরকে বলা হচ্ছে মোবাইল প্রসেসর।
গাঠনিক দিক দিয়ে মোবাইল প্রসেসর ও কম্পিউটার প্রসেসরের মধ্যে কিছু পার্থক্য বিদ্যমান। যেমনঃ কম্পিউটারে জিপিউ আলাদা হলেও মোবাইল প্রসেসরের জিপিইউ এর সিপিইউ’র মধ্যে যুক্ত করা থাকে। গাঠনিক পার্থক্য থাকলেও উভয় প্রসেসরই মূলত একই নিয়মে কাজ করে।
প্রসেসর কি ও এ সম্পর্কে কিছু বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন
কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের প্রসেসরের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য আছে। প্রথমত, কম্পিউটারের প্রসেসর তার উল্লেখকৃত স্পিডে বেশিরভাগ সময় কাজ করতে পারে। কিন্তু মোবাইলের প্রসেসর তার উল্লিখিত স্পিডে বেশিরভাগ সময় কাজ করেনা কারণ এতে প্রসেসর প্রচুর গরম হয়ে যাবে যা ডিভাইসের জন্য ক্ষতিকারক। এছাড়া কম্পিউটারের প্রসেসর মোবাইলের প্রসেসরের চেয়ে বেশি শক্তি খরচ করে ও বেশি তাপ উৎপাদন করে।
অন্য যেকোনো ইলেকট্রনিক পার্টসের মত প্রসেসরও নষ্ট বা অকেজো হয়ে যেতে পারে। তবে আপনার পিসিতে যদি তাপমাত্রা কমানোর ব্যবস্থা ঠিকঠাক থাকে তাহলে এর প্রসেসর উচ্চতাপমাত্রার হাত থেকে সুরক্ষিত থাকবে যা প্রসেসরকে তাপজনিত ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করবে। ফোনের জন্যও এই কথা প্রযোজ্য।
শেষকথা – প্রসেসর কি? প্রসেসর কীভাবে কাজ করে?
প্রসেসর বা সিপিইউ কম্পিউটার/মোবাইল ফোনের (এবং আরো অনেক ডিভাইসের) একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রসেসরসমুহ কম্পিউটারে ডাটা প্রসেস করার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রোগ্রাম চালাতে সাহায্য করে। সম্প্রতি প্রসেসরের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি লক্ষণীয় হয়েছে।
মাল্টি-কোর প্রসেসরের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি হাইপার-থ্রেডিং এর মত প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে কম্পিউটার আরো দ্রুত ও কার্যকরভাবে অপারেট করতে পারে। প্রসেসর বা সিপিইউ সম্পর্কে উল্লিখিত লেখা ভালোভাবে পড়ে থাকলে এতক্ষণে নিশ্চয় প্রসেসর সম্পর্কে ব্যাসিক একটি ধারণা পেয়ে গিয়েছেন।
প্রসেসর সম্পর্কিত আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে আমাদের জানাতে পারেন কমেন্ট সেকশনে। আপনার প্রশ্নের যথাযথ জবাব দেওয়ার চেষ্টা করবো আমরা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন