ভুল করে হওয়া ৪টি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার
সেই আদিম যুগ থেকেই মানুষ মেতে ছিল আবিষ্কারের নেশায়। কখনো প্রয়োজনে, কখনো বা উন্নত জীবনের আশায় মানুষের কঠোর পরিশ্রম একে একে এনে দিয়েছে অসংখ্য আবিষ্কার।
তবে বর্তমানে এসব আবিষ্কার সম্পর্কে আমরা যতটা সহজেই জানতে পারছি বা তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা সমালোচনা করতে পারছি, আবিষ্কারগুলো কিন্তু মোটেও অতটা সহজ ছিল না। বিজ্ঞানীদের ক্ষুরধার মস্তিষ্ক আর কঠোর অধ্যবসায় ছাড়া কোন ভাবেই এমন দুরূহ পথে সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না।
ভুল করে হওয়া ৪টি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার
প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রতিটি আবিষ্কারই যেন একেক টি নতুন গল্প বলে গেছে। তবে প্রতিটি আবিষ্কারের পেছনে রয়ে যাওয়া এমন গল্পের খুব কমই আমাদের সামনে আসে। আর যেগুলো আমরা জানতে পারি তার পেছনের ঘটনা ঘাটিতে পারলে আমরা জানতে পারি কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার গল্প।
তবে শুধু রসকষ হীন অধ্যবসায়ের গল্প নয়, কিছু কিছু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে মজাদার বা উদ্ভট কিছু ঘটনাও। সংক্ষেপে বলতে গেলে সব আবিষ্কারই উদ্দেশ্যযুক্ত ছিল না, এমন কিছু আবিষ্কার ছিল যা মোটেও কারো ধারণায় ছিল না এবং বলতে গেলে ভুল করে বা দুর্ঘটনাবশতই এ আবিষ্কারগুলো হয়েছে বিভিন্ন বিজ্ঞানীর হাত ধরে।
আজ আমরা এমনই ভুল করে হওয়া কিছু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সম্পর্কে জানব। তো চলুন দেখে নেওয়া যাক এমন কিছু আবিষ্কার।
১। এক্স রে
এক্স রে’র নাম শোনেন নি এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। বিভিন্ন চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যাপারে যে পরীক্ষা গুলো করা হয় তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে পরীক্ষাটি প্রচলিত তা হল এক্স-রে টেস্ট। শরীরের অভ্যন্তরে কোন স্থানে দেখার জন্য এই টেস্টটি বহুল প্রচলিত।
কিন্তু মজার ব্যাপার হল এটি গবেষণা লব্ধ কোন আবিষ্কার বা কোন কঠিন সাধনার ফল নয়। অনেকটা আকস্মিক ভাবেই আবিষ্কৃত হয় আজকের চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী রশ্মি এক্স রে।
১৮৯৫ সালে উইলহেলম রন্টজেন এক্স রে বা রঞ্জন রশ্মি আবিষ্কার করেন। তবে জার্মান এই বিজ্ঞানী অনেকটা নিজের অজ্ঞাতেই এক্স রে আবিষ্কার করে ফেলেন। ১৮৯৫ সালে একদিন তিনি ক্যাথোড রে টিউব নিয়ে একটি পরীক্ষা করছিলেন।
তিনি দেখার চেষ্টা করছিলেন যে ক্যাথোড রশ্মি কাচের ভেতর দিয়ে ভেদ করতে পারে কি না। পরীক্ষা টি করার সময় ক্যাথোড রে টিউব টি মোটা কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল এবং ঘর ছিল সম্পূর্ণ অন্ধকার। কিন্তু তা সত্ত্বেও রন্টজেন একটি অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করলেন।
তিনি ক্যাথোড রে টিউবের পাশেই রাখা একটি প্রতিপ্রভ পর্দায় একটি সবুজ আলো দেখতে পেলেন যা কি না ক্যাথোড রে টিউব থেকে নির্গত হচ্ছিল। এটি লক্ষ করার পর তার আগ্রহ আরও বেড়ে যায় এবং আরও কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। তিনি দেখতে পান যে এই অদ্ভুত আলোক রশ্মি অধিকাংশ বস্তুর মধ্য দিয়েই ভেদ করে যেতে পারে। এই অজানা এবং অদ্ভুত ক্ষমতার রশ্মিটিকে তাই রন্টজেন নাম দেন ‘x-ray’ অর্থাৎ ‘অজানা রশ্মি’।
২। পেনিসিলিন
১৯২৯ সালে নিতান্তই দুর্ঘটনাবশত অ্যালেক্সান্ডার ফ্লেমিং তাঁর ল্যাবরেটরিতে আবিষ্কার করেছিলেন পৃথিবীর প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন।
আলেকজান্ডার ফ্লেমিং ছিলেন সেন্ট মেরিস হাসপাতালের জীবাণু-বিদ। সেবার গ্রীষ্মের ছুটিতে বের হওয়ার আগে তার ল্যাবরেটরিতে একটি পেট্রি ডিশে কালচার করা স্ট্যাফাইলোকক্কাস অরিয়াস ব্যাকরেটেরিয়া রেখে গেলেন।
তবে ছুটি কাটিয়ে এসে তিনি খানিকটা অবাকই হলেন। তার কালচার করা স্ট্যাফাইলোকক্কাস অরিয়াস ব্যাকটেরিয়ার পেট্রি ডিশে তিনি কিছু ছত্রাক দেখতে পেলেন। আর এই ছত্রাকটি ছিল পেনিসিলিয়াম নোটাটাম।
তিনি অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পরীক্ষা করে দেখলেন এই ছত্রাকটি স্ট্যাফাইলোকক্কির স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে বাধা তৈরি করছে। আলেকজান্ডার ফ্লেমিং আরও কয়েক সপ্তাহ সময় নিয়ে বেশ কিছু পেনিসিলিয়াম ছত্রাক জোগাড় করে পরীক্ষা করে দেখলেন যে পেনিসিলিয়ামের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলো শুধু ব্যাকটেরিয়ার স্বাভাবিক বৃদ্ধিকেই বাধা দেয় না, সংক্রামক অনেক রোগ প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখতে পারে।
যদিও পেনিসিলিন আবিষ্কারের পেছনে আরও কিছু বিজ্ঞানীর অবদান রয়েছে, তবে শুরু টা এমন হঠাৎ করেই হয়েছিল।
৩। মাইক্রোওয়েভ ওভেন
মাইক্রোওয়েভ ওভেন বিশ্বের একটি অন্যতম জনপ্রিয় গৃহস্থালি যন্ত্র। কিন্তু কিভাবে আবিষ্কৃত হল চমৎকার এই যন্ত্রটি তা খুব কম লোকই জানে। সম্পূর্ণ এক আকস্মিক ঘটনার মাধ্যমে বিজ্ঞান পেয়েছিল মাইক্রোওয়েভ ওভেন কে।
১৯৪৫ সালে পার্সি স্পেন্সার নামক একজন আমেরিকান প্রকৌশলী একদিন ল্যাবে কাজ করছিলেন। তিনি ম্যাগনেট্রন নামক রাডারের ভিতরে থাকা উচ্চ-শক্তিযুক্ত ভ্যাকুয়াম টিউব নিয়ে কাজ করছিলেন। একদিন ম্যাগনেট্রন নিয়ে কাজ করার সময় স্পেন্সার লক্ষ্য করলেন তার পকেটে রাখা পিনাট বাটারের একটি ক্যান্ডি বার গলতে শুরু করেছে। স্পেন্সার বুঝে ফেললেন রাডারে ব্যাবহৃত মাইক্রোওয়েভ এর কারণেই এমনটি হয়েছে।
বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর ১৯৪৫ সালে তিনি প্রথম মাইক্রোওয়েভ ওভেন তৈরি করেন, আকারে সেটি ঢাউস একটি জিনিস ছিল। ১৯৬৭ সাল থেকে মাইক্রোওয়েভ ওভেন যুক্তরাষ্ট্রের ঘরে ঘরে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়। এখন তো পৃথিবীজুড়ে মাইক্রোওয়েভ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় যন্ত্র।
৪। ডিনামাইট
আসসিয়ানো সোব্রেরো নামটি আমাদের অনেকেরই কাছে অপরিচিত। বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ আবিষ্কারে এই লোকটির অবদান রয়েছে অনেক।
তিনি ১৮১২ সালে ইতালির ক্যাসালে মনফেরাতো জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং পেশায় ছিলেন একজন রসায়নবিদ। ১৮৪০ এর দশকে প্যারিসের একটি পরীক্ষাগারে কাজ করার সময় তিনি নাইট্রোগ্লিসারিন নামে একটি পদার্থ আবিষ্কার করেছিলেন যা ছিল একটি তৈলাক্ত এবং অত্যন্ত বিস্ফোরক তরল।
কিন্তু সোব্রেরো তা আবিষ্কারের সম্ভাব্য বাণিজ্যিক ব্যাবহার দেখে যেতে পারেন নি। তবে সেই কাজটি করে দেখাতে পেরেছেন অ্যালফ্রেড নোবেল নামের একজন সুইডিশ কেমিস্ট।
আসসিয়ানো সোব্রেরো আবিষ্কৃত বিস্ফোরক তরলটি অত্যন্ত বিপজ্জনক হওয়ায় সেটি বাণিজ্যিক ভাবে ব্যাবহার করার মত কোন পরিস্থিতি তখন তৈরি হয়েছিল না। তাই নোবেল ভাবলেন তিনি যদি কোনোভাবে এই পদার্থটিকে নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারেন তাহলে তৎকালীন গতানুগতিক বিস্ফোরকের একটি ভাল ও কার্যকর বিকল্প তৈরি করতে সক্ষম হবেন।
পড়াশোনা শেষ করার পর, আলফ্রেড এটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। তবে এই গবেষণা চালাতে তাকে বেশ চওড়া মূল্যও দিতে হয়েছিল। একবার গবেষণা চলাকালে তার কারখানায় এক ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটে এতে কয়েকজন শ্রমিক সহ তার ভাই 'এমিল' মারা যান।
ভাইয়ের মৃত্যুতে নোবেল ভীষণ ভাবে ভেঙ্গে পড়েন। এই ঘটনার পর আলফ্রেড নোবেল নিরাপদ-ভাবে বিস্ফোরণ ঘটানোর উপকরণ আবিষ্কারের জন্য উঠে-পড়ে লাগেন। তবে তার চেষ্টা শত চেষ্টা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত আবিষ্কারটি দেখা দেয় আরেকটি দুর্ঘটনার মাধ্যমে।
একবার নাইট্রোগ্লিসারিন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেওয়ার সময় নোবেল দেখেন একটি পাত্র ছিদ্র হয়ে খুলে গেছে। দেখা গেল পাত্র মোড়ানো ছিল যে জিনিসটি দিয়ে সেটি ভয়াবহ বিস্ফোরক নাইটড়োগ্লিসারিনকে খুব ভালোভাবে শোষণ করেছে। কিয়েসেলগার নামে এক ধরনের পাললিক শিলার মিশ্রণ দিয়ে পাত্রগুলো মোড়ানো ছিল।
নাইট্রোগ্লিসারিন যেহেতু তরল অবস্থায় খুব বিপদজনক, তাই নোবেল সিদ্ধান্ত নেন এই কিয়েসেলগারকে তিনি বিস্ফোরকের স্ট্যাবিলাইজার হিসাবে ব্যবহার করবেন। ১৮৬৭ সালে নোবেল তার আবিষ্কৃত নিরাপদ কিন্তু মারাত্মক শক্তিশালী এই বিস্ফোরকটি ‘ডিনামাইট’ নামে পেটেন্ট করান।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন